আজ
|| ২২শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ || ৮ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ || ২৩শে জিলকদ, ১৪৪৬ হিজরি
আমরা জানি, কবিতাই আদি শিল্প। হয়তো ছড়ার ফর্মে ছিল সূচনালগ্নে, পরে অনেক বাঁকবদলের পরে থিতু হয়েছে। কথাসাহিত্যের জন্মেরও আগে কবিতার উদ্ভব। বিস্তৃতি ও ক্রমবিকাশের ইতিহাস বড়ই বিচিত্র, নানা চড়াই উৎরাই পার হয়ে আজকের পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে কবিতা। এক সময় কবিতা গীত হতো, বাদ্যযন্ত্রের সহযোগে। কাগজ আবিষ্কারেরও অনেক আগে থেকেই মুখে মুখে রচিত হতো ছড়া, কবিতা। মানুষ মুখস্থ করত, অন্যকে শুনিয়ে প্রীত হতো। একই সঙ্গে নিজেও বিনোদিত হতো। মা-বোন, ফুপু-খালা, দাদি-নানিরা তো শিশুদের ঘুম পাড়াতেন সুর বসানো ছড়া বা গান শুনিয়েই। সে এক চিরন্তন ঐতিহ্য-যা প্রায় লুপ্ত হয়ে গেছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অতি অগ্রগতির বদৌলতে। তারপরও সেই গৌরবময় ঐতিহ্য ও পরম্পরা কিছুটা হলেও আমরা বহন করে চলেছি নির্মল আনন্দে ও যত্নে পরিচর্যায়। সেটাও কম কথা নয়। ছন্দদোলার প্রতি মানুষের যে অনুরাগ ও প্রীতি-পৃষ্ঠপোষকতা, তা সহজাত। এটা কোনোমতেই আরোপিত বা কষ্টকল্পিত কোনো ব্যাপার নয়।
বাংলা লোকছড়ার ঐতিহ্য অত্যন্ত ঋদ্ধ, বৈচিত্র্যমণ্ডিত, চিরন্তনী স্বাদে স্বাদু। প্রাচীনও বটে। এ এক আশ্চর্য সম্পদ এবং আশীর্বাদ। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর তাৎপর্য, গুরুত্ব ও মর্ম উপলব্ধি করে অনেক লোকছড়া সংগ্রহ ও লিপিবদ্ধ করে গেছেন। ‘ছেলেভুলানো ছড়া : ২’ শিরোনামের প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন,
“আমাদের অলঙ্কারশাস্ত্রে নয় রসের উল্লেখ আছে, কিন্তু ছেলেভুলানো ছড়ার মধ্যে যে রসটি পাওয়া যায়, তাহা শাস্ত্রোক্ত কোনো রসের অন্তর্গত নহে। সদ্যঃকর্ষণে মাটি হইতে যে সৌরভটি বাহির হয়, অথবা শিশুর নবনীতকোমল দেহের যে স্নেহোদ্বেলকর গন্ধ, তাহাকে পুষ্প চন্দন গোলাপ-জল আতর বা ধূপের সুগন্ধের সহিত এক শ্রেণিতে ভুক্ত করা যায় না। সব সুগন্ধের অপেক্ষা তাহার মধ্যে যেমন একটি অপূর্ব আদিমতা আছে, ছেলেভুলানো ছড়ার মধ্যে তেমনি একটি আদিম সৌকুমার্য আছে-সেই মাধুর্যটিকে বাল্যরস নাম দেওয়া যাইতে পারে। তাহা তীব্র নহে, গাঢ় নহে, তাহা অত্যন্ত স্নিগ্ধ সরস এবং যুক্তিসঙ্গতহীন।
শুদ্ধমাত্র এ রসের দ্বারা আকৃষ্ট হইয়াই আমি বাংলাদেশের ছড়া-সংগ্রহে প্রবৃত্ত হইয়াছিলাম। রুচিভেদবশত সে রস সবার প্রীতিকর না হইতে পারে, কিন্তু এ ছড়াগুলো স্থায়ীভাবে সংগ্রহ করিয়া রাখা কর্তব্য সে বিষয়ে বোধ করি কাহারও মতান্তর হইতে পারে না। কারণ, ইহা আমাদের জাতীয় সম্পত্তি। বহুকাল হইতে আমাদের দেশের মাতৃভাণ্ডারে এ ছড়াগুলো রক্ষিত হইয়া আসিয়াছে; এ ছড়ার মধ্যে আমাদের মাতৃ-মাতামহীগণের স্নেহসংগীতস্বর জড়িত হইয়া আছে, এ ছড়ার ছন্দে আমাদের পিতৃ-পিতামহগণের শৈশবনৃত্যের নূপুরনিক্বণ ঝংকৃত হইতেছে। অথচ, আজকাল এই ছড়াগুলি লোকে ক্রমশই বিস্মৃত হইয়া যাইতেছে। সামাজিক পরিবর্তনের স্রোতে ছোট বড় অনেক জিনিস অলক্ষিতভাবে ভাসিয়া যাইতেছে। অতএব, জাতীয় পুরাতন সম্পত্তি সযত্নে সংগ্রহ করিয়া রাখিবার উপযুক্ত সময় উপস্থিত হইয়াছে।...”


গুরুতর যে বিষয় এক্ষণে আমাদের সমীপে উপস্থিত, কম কথায় এবং কম সময়ে তার গভীরে প্রবেশ এবং প্রকৃত প্রস্তাবে লক্ষ ঝিনুক ভেঙেচুরে যৎকিঞ্চিৎ মুক্তো আহরণ করার কাজটি অত্যন্ত শ্রমসাধ্য ব্যাপার। এক প্রকার অসম্ভবও বটে। সুতরাং বর্তমান প্রবন্ধে উচ্চ মানের কোনো সারবত্তা প্রত্যাশা করা মোটেও ঠিক হবে না। অতীব দ্রুততায় মোটা দাগে নির্ধারিত বিষয়ে মৌল কিছু প্রবণতা চিহ্নিত করার প্রয়াস থাকবে সে কারণে, এ প্রবন্ধ মূলত স্বল্প সময়ে এতদসংক্রান্ত পর্যবেক্ষণের একটি খসড়া মাত্র। এ ঊনতার জন্যে গোড়াতেই মার্জনা চেয়ে নিচ্ছি।
কবিতার ভেতরের যে জগৎ, তা অতি অবশ্যই দুর্জ্ঞেয় এবং অতলান্ত। শব্দে রচিত, কিন্তু শব্দাতীত এক বোধের উৎস। একটি চরণে বিধৃত যে ছবি, তা এক এক সময় এক এক ধরনের উপলব্ধি এনে দিতে পারে। কবিতা কোনোমতেই সাদামাঠা কোনো শব্দসমষ্টি নয়, এ এক জীবন্ত সত্তা। এর আধেক ধরা যায় হয়তো, বাকি আধেক থেকে যায় অধরা। সে যেন এক অতীন্দ্রিয়তার উদ্ভাসন। পাঠকের মনের গহন কোণে সুরমূর্ছনা তোলে কবিতা, রেশ থেকে যায়, দুঃখ-সুখের ছন্দায়িত দোলায় পাঠক মন উন্মন করে তোলে। আবৃত্তিশিল্পীর কাজটা কী মূলত? সেই অদ্ভুত প্রাণরসকে শ্রোতার হৃদয়ে শিল্পিত নৈপুণ্যে সঞ্জীবিত করে দেওয়া। কণ্ঠের কারুকাজে নতুন মাত্রা সংযোজন করে আরও হৃদয়গ্রাহী করে তোলা। কবি যদি কবিতার প্রসবিনী জননী, আবৃত্তিকারকে বলতে পারি দুধ-মা। মাতৃস্নেহের উমে তিনি লালন করেন কবিতা, আত্মায় আত্মস্থ করেন, শ্রোতার মর্মে মননে সেই নির্যাস মধু সঞ্চালিত করে দেন। এই যে পারফর্মিং আর্ট, এ কাজটা মোটেও সাধারণ বা এলেবেলে নয়। বরং বলা চলে, কখনো কখনো কবিতা লেখার চেয়েও কঠিন। এ এক বিরাট চ্যালেঞ্জ বৈকি। শুধু চ্যালেঞ্জই নয়, যথেষ্ট বিপজ্জনকও বটে। আবৃত্তিকাররা কবিতাকে পৌঁছে দিচ্ছেন বৃহৎ পরিসরে, নিজেদের দীর্ঘ শ্রম, অনুশীলন-চর্চা, মেধা মনীষা ও সাধনালব্ধ অর্জনের দ্বারা তৈরি করছেন আগ্রহী শ্রোতা, কবিতার মতো স্পর্শকাতর শুদ্ধ একটি শিল্পকে নিয়ে সাধনভজন করে চলেছেন নিরন্তর। তাদের এ নিষ্ঠা, অধ্যবসায়, ধৈর্যশীল কণ্ঠ পরিশীলনকে তাচ্ছিল্য করার, ছোট করে দেখার বা এড়িয়ে চলার কোনো উপায় নেই। তার কোনো প্রয়োজনও অবশ্য নেই। বরং আমরা বলতে পারি, কবি ও আবৃত্তিকার হচ্ছেন একে অন্যের পরিপূরক। একই বৃন্তে দুটি কুসুম। একটি গান যখন গীতিকারের খাতায় লিপিবদ্ধ থাকে, তখন সেটির আবেদন কতটুকু? খাতা থেকে ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হলেও পাঠকের মর্মে কতটা পৌঁছায়? যখন তাতে সুর বসে, শিল্পীর কণ্ঠমাধুর্যে, যন্ত্রাণুষঙ্গে জীবন্ত হয়ে ওঠে তখন এর আবেদন হয়ে ওঠে অসাধারণ। সুতরাং দেখা যাচ্ছে এটি একটি সমবায় শিল্প। কবির লেখা কবিতা, সেটি আবৃত্তিকারের সুললিত কণ্ঠে পরিবেশিত হলে পায় নতুন মাত্রা, দ্যোতনা ব্যঞ্জনা। সুতরাং একে বলতে পারি যৌথ শিল্প।
আবৃত্তি কাকে বলব? একটা সময় ছিল যখন বলা হতো বারবার পাঠ করাকে মনে করা হতো আবৃত্তি। সময় বদলেছে, সংজ্ঞা-ধারণাও পালটে গেছে সেই সঙ্গে। বিবর্তিত হয়েছে সব কিছুই। শুদ্ধ ও সুন্দর প্রমিত উচ্চারণে কণ্ঠমাধুর্যে কবিতা বা গদ্যাংশকে চিত্তাকর্ষক করে শ্রোতাদের কাছে পরিবেশনাকে বলতে পারি আবৃত্তি। কঠিন অনুশীলন, প্রশিক্ষণ, কণ্ঠব্যায়াম প্রয়োজন হয় ভালো আবৃত্তি করবার জন্য। রবিশঙ্কর মৈত্রী তার বইয়ে বলছেন,
‘আবৃত্তিকার তার অনুভব আবেগ শ্রোতাদের কাছে পৌঁছে দেন। আবৃত্তিকার বলেন, শ্রোতারা শোনেন। এ মুখোমুখি সংযোগের মধ্যে তেমন কোনো আড়াল নেই। আবৃত্তিকার তার কণ্ঠস্বরের ওঠা-নামায়, উচ্চারণে, বাচনভঙ্গিতে একটি সুন্দর আবহ তৈরি করেন। আবৃত্তিকার লেখক বা কবির সঙ্গে শ্রোতার সরাসরি সংযোগ ঘটিয়ে দেন, কিন্তু তিনি লেখক বা কবির ধারক-বাহক কিংবা প্রচারকও নন। একজন সার্থক আবৃত্তিকার যখন যে কবির বা লেখকের লেখা আবৃত্তি করেন তখন তিনি সেই কবি বা লেখককে নিজের অনুভবে নতুন প্রাণ দিয়ে কণ্ঠে তুলে আনেন।’
সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠবে, সকল আবৃত্তিকার কী কবিতার ভেতরমর্ম কিংবা অন্তর্জগতে পৌঁছতে পারেন? এর সরল ও সহজ উত্তর হচ্ছে : না। খুব কমসংখ্যক আবৃত্তিকারই সেই সিদ্ধি অর্জন করতে সক্ষম। কবিতা একটি জীবন্ত সত্তা। তাকে প্রাণময় করে সঞ্জীবনী রসসুধায় সিক্ত করে পরিবেশনার কাজটি অত্যন্ত জটিল ও দুঃসাধ্য। ঠিক কোনখানে কোন শব্দের ওপর বিশেষ জোর দিতে হবে, কোনখানে কোন এক্সপ্রেশন দরকার, সেটা সব আবৃত্তিকার হৃদয়ঙ্গম করতে পারেন, এ কথা আমরা জোর করেও বলতে পারি না। স্রষ্টা কবিই মূলত জানেন, কোনখানে কোন স্বর প্রক্ষেপণ বাঞ্ছনীয় ও যুক্তিযুক্ত। সেটা দ্বিতীয় ব্যক্তির পক্ষে অনুধাবন ও আত্মীকরণ করা মোটেও চাট্টিখানি কথা নয়। সে জন্য একটি উৎকৃষ্ট মানের কবিতাও উপস্থাপনের দৌর্বল্যে কিংবা অদক্ষতায় মাটি হয়ে যেতে পারে। এ ঝুঁকি কিন্তু সব সময়ই বিদ্যমান থাকে। এটা এড়ানোর জন্য সদা সতর্ক ও সচেষ্ট থাকতে হয় আবৃত্তিকারকে। কবিতাকে জীবন্ত, স্বতঃস্ফূর্ত করে তোলার জন্য যোগ করতে হয় নতুন মাত্রার স্পন্দন ও দোলা। এ বিষয়ে যার মুনশিয়ানা যত গভীর, তিনি তত সফল।
কবিদের স্বকণ্ঠ আবৃত্তির মধ্যে দুটো লাভ আছে, শ্রোতার তরফে। কবিতা তো কবির নিজের সন্তান, পারফর্মিং আর্টের মর্যাদা যুক্ত করতে পারে আরেক মাত্রা। বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশের কবিদের মধ্যে অনেকের উচ্চারণ সুবিধের নয়। প্রমিত, শুদ্ধ নয়। এ কথাটা আমাকে গভীর দুঃখের সঙ্গেই বলতে হচ্ছে। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছেন, তবে তাদের সংখ্যা মুষ্টিমেয়। খুবই কম বলতে হয়। কবিদের দোষও দিতে চাই না। তারা পারফরমার নন, সুতরাং বাচিক শিল্পী হওয়ার দায় বা প্রয়োজন কোনোটাই নেই তার। কবিতা সুন্দর সুললিত কণ্ঠে পরিবেশন করে অন্যের মনোরঞ্জন করার কাজটি অতীব দুরূহ। সে জন্য দরকার হয় দীর্ঘ সাধনা, প্রশিক্ষণ, কণ্ঠ পরিচর্যা, সযত্ন অধ্যবসায়। সর্বোপরি কবিতার মর্মে প্রবেশ করার ক্ষমতা। এ পারঙ্গমতা ও সিদ্ধি কোনো সহজাত বা সুলভ ব্যাপার নয়। রাতারাতি এ ব্যাপারে সাফল্য আশা করা বাতুলতা মাত্র। কোনো শর্ট কার্ট নেই।
কবিতার অন্তর্জগতের প্রসঙ্গে যেতে হয় এবার। আমি পেশায় সাংবাদিক বলে অনেক বরেণ্য ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্য পাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে। বিশ্বনন্দিত সংগীতজ্ঞ পণ্ডিত রবিশঙ্করের সাক্ষাৎকার নিয়েছি আমি। একাধিকবার। উচ্চাঙ্গসংগীতের সমঝদার প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, যে কোনো এলেবেলে মানুষ উচ্চাঙ্গসংগীতের মর্ম বুঝবেন, রস আস্বাদন করতে সক্ষম হবেন, এমনটা আশা করা ঠিক নয়। উচ্চাঙ্গসংগীত থেকে আনন্দ আহরণ করার জন্য পরিশ্রম করতে হবে। নিজেকে তৈরি করতে হবে প্রথমে। অনেক ভেবে দেখেছি আমি, পণ্ডিত রবিশঙ্করের এ কথাটি খুবই খাঁটি। এটা কিন্তু কবিতার ক্ষেত্রেও খাটে। পাঠকের উপযুক্ত প্রস্তুতি না থাকলে কবিতার অন্তর্জগতের রহস্য অনুধাবন করা যাবে না। থাকতে হবে গভীর প্যাশন, সূক্ষ্ম অনুভূতি, সংবেদনশীল মন, বৃদ্ধিবৃত্তিক প্রজ্ঞা। কবিতায় নির্মিত হয় যে ছবি, তার অন্তর্নিহিত সৌন্দর্যের একাগ্র একজন সমঝদার হওয়া কোনো বিবেচনায়ই সহজ নয়। এই যে অন্তর্জগতের নিবিষ্ট অনুসন্ধান, এ বৃত্তিকে ফ্যাশন হিসাবে নিয়ে বা হুজুগে মেতে ওঠে তাতে রাতারাতি সাফল্য পাওয়া দুষ্কর। ভেতর থেকে টান ও তাগিদ অনুভব করতে হবে। নিবিড় ভালোবাসাই দিতে পারে অন্তর্জগতের মোহন ভুবনে প্রবেশের ও অবস্থানের রস আস্বাদনের মহামূল্য ভিসা।
সাম্প্রতিক বাংলাদেশে আবৃত্তিচর্চা এখন ব্যাপক। মাত্রা একটু বেশিই বলতে হয়। দেশজুড়েই এ চর্চা জনপ্রিয় হচ্ছে দিন দিন। ব্যক্তিক ও সাংগঠনিক উদ্যোগ আয়োজন বিস্তৃতি ও প্রসার পাচ্ছে ক্রমশ। কিন্তু উৎকর্ষ কতটা আছে ওতে, এই প্রশ্ন প্রাসঙ্গিক। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে, সত্তরের দশকে আমরা যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম, জানা মতে, তখন আবৃত্তির সংগঠন ছিল একটি মাত্র। এখন সেখানে অগণন সংগঠন। সারা দেশেও এ তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়েছে। তাকে ব্যাপকই বলতে হয়। সেটাকে নেতির চোখে দেখার কোনো যুক্তি নেই। আবৃত্তিচর্চার সঙ্গে যুক্ত হওয়া স্ট্যাটাস সিম্বল কারও কারও কাছে। ফ্যাশনও মনে করতে পারেন কেউ কেউ। সংগঠনের প্রাচুর্য আছে ঠিকই, উৎকর্ষ সিদ্ধি কিন্তু তুলনামূলকভাবে কম। আশা যেমন রয়েছে, আশঙ্কাও নিতান্ত কম নয়।
আবৃত্তিচর্চার মূল্যায়ন ও পৃষ্ঠপোষকতার প্রশ্নে আমাদের প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া ঈপ্সিত পরিমাণে সহায়তা-উদারতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, এ কথা বলতে পারলে নিঃসন্দেহে ভালো লাগত। কিন্তু আফসোস, এ কথাটি বলতে পারছি না। আবৃত্তি নিয়ে স্বতন্ত্র অনুষ্ঠানই হতে পারে, ইলেকট্রনিক মিডিয়ায়। রেডিওতেও হতে পারে। একটু আধটু যে নেই, তা নয়। হওয়া দরকার বেশি বেশি। সেটি অনেকটা সময় নিয়ে হতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। সংবাদপত্রের সাহিত্য সাময়িকীগুলোতেও আবৃত্তিবিষয়ক লেখা বিশেষ ছাপা হয়, এমনটা দাবি করা চলে না। তবে এ কথাও সত্য যে আবৃত্তি নিয়ে লেখালেখির লোকও কম। সাময়িকী সম্পাদকদের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো অযৌক্তিক হবে। কারণ আমাদের দেশের যারা প্রবীণ, সফল স্বনামধন্য আবৃত্তিকার, তারা কী লেখেন এ বিষয়ে? যাও বা লেখেন, তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। বাচিক শিল্পের সংকট, সম্ভাবনা, উত্তরণের উপায় সম্পর্কে দিকনির্দেশনা থাকতে পারে এ সংক্রান্ত লেখায়। তা থেকে নবীনরা উপকৃত হতে পারেন, গাইডলাইন পেতে পারেন। আবৃত্তিবিষয়ক প্রকাশনাও নিতান্ত কম এখনো পর্যন্ত। যদিও চাহিদা আছে বেশ ভালোরকমই। আবৃত্তি সংক্রান্ত বইগুলোর একাধিক সংস্করণ-মুদ্রণের ঘটনা আমার এ বক্তব্য ও পর্যবেক্ষণের সপক্ষে প্রত্যক্ষ প্রমাণ। বাংলাদেশ শিশু একাডেমিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে শিশুদের জন্য আবৃত্তি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। এ সুযোগ শুধু রাজধানীতেই সীমিত নয়। বিকেন্দ্রিত যে হয়েছে, তা অবশ্যই আশার কথা। প্রাঞ্জল ভাষায় শিশুদের জন্য আবৃত্তি শেখার বই আছে কিছু। দরকার আরও অনেক। আবৃত্তিকে পাঠক্রমের আওতাভুক্ত করার বিষয়টি নিয়েও চিন্তাভাবনা করার সময় এসেছে। শিশু বয়সেই এ ব্যাপারে সচেতন করে তোলা গেলে সুফল মিলবে নিশ্চয়ই। বাংলাদেশে আবৃত্তির সময় সংগীতযন্ত্রের ব্যবহার বিশেষ দেখা যায় না। ফিউশনের ওপরও গুরুত্ব প্রদানের সময় এসেছে বলে মনে করি।