• শনিবার, ১৭ মে ২০২৫, ০২:৫৭ অপরাহ্ন

বাংলাদেশের কবিতার স্বরূপ

বিমল গুহ / ৭১ Time View
Update : শুক্রবার, ১ নভেম্বর, ২০২৪

সময় ও জীবনের গতিপ্রকৃতিই মূলত সাহিত্য-শিল্পের গতিধারা নির্ধারণ করে। বাংলা কবিতাও কালে কালে চলার পথের নানান বাঁক পরিবর্তন করে এগিয়ে চলেছে। মানুষের চিন্তার ভিন্নতা হলে সমাজে ও সাহিত্যে পরিবর্তন আসে, রূপান্তর হয় সংস্কৃতিরও। মানুষের এই অন্তর্গত চেতনাই এক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। কালে কালে সময়ের অভিঘাতে কবিদের মনোজগতেও পরিবর্তন আসে। সামাজিক অসঙ্গতি, যুদ্ধবিগ্রহ কিংবা অসাম্যের কারণেও পরিবর্তন হয় কবিতার আদল।

কবিতা সময়কে ধারণ করে এবং কালক্রমে সময়কে অতিক্রম করে যায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পূর্ব কিংবা স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে এ অঞ্চলের মানুষের চিন্তার জগতে যে পরিবর্তন আসে কিংবা শিল্পী-কবি-সাহিত্যিকদের মনোজগতে যে-বোধের জন্ম হয়-তার স্পষ্ট প্রকাশ আমাদের কবিতা। এই অঞ্চলের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের রূপ, কিংবা মুক্তিযুদ্ধ ও তৎপরবর্তীকালের অনুভব আমাদের কবিতায় প্রকাশিত হয়েছে-যা আমাদের কবিতাকে দাঁড় করিয়েছে বিশ^সাহিত্যের সোপানে। এই যে বলতে পারছি আমাদের কবিতা এগিয়েছে, এর নিক্তি হলো পাঠকের মনোজগতের বিকাশ। একে আমরা কোনো সংজ্ঞায় আবদ্ধ না করেও বলতে পারি-আমাদের কবিতা সমকালের চেতনাবাহী।

আমাদের স্বাধীনতা এবং তৎপূর্বকালের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি, বাঙালির অস্তিত্ব রক্ষার মরণপণ-সংগ্রাম-জাতীয় জীবনের সকল ক্ষেত্রে এনে দিয়েছে অনিবার্য পরিবর্তন। আর প্রসারিত হতে থাকে আমাদের কবিতার দিগন্ত। মুক্তিযুদ্ধের বৃহত্তর পটভূমি জাতির সামনে খুলে দেয় চিন্তার নতুন আকাশ। পরিবর্তিত মূল্যবোধে নতুন স্বপ্নে উজ্জীবিত হন কবিরা। এরকম পরিস্থিতিতে তাদের কলমে উঠে আসে জীবন ও জগতের অন্তর্ভেদী উচ্চারণ। সত্তরের নির্বাচনোত্তরকালে বাংলার মানুষের রাজনৈতিক চেতনা একটি বিন্দুতে এসে স্থিত হয়। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের স্বাধীনতার ডাকে পাল্টে যায় রাজনৈতিক দৃশ্যপট। বাংলার মানুষ লিপ্ত হয় মরণপণ সংগ্রামে। আমাদের কবিতার শানিত উচ্চারণ-আধুনিক মারণাস্ত্রের চাইতেও শক্তিমান হয়ে ওঠে। মুক্তিযোদ্ধারা দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে গেলে পাকিস্তানি হানাদারকে একসময় লেঙ্গুর তুলে পালাতে হয়। বাংলা কবিতার অগ্নিপুরুষ কাজী নজরুল ইসলাম আর জীবনানন্দ দাশের কবিতা উচ্চারিত হয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের মুখে, যুদ্ধের ময়দানে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ ছিল আমাদের স্বাধীনতার অন্তর্গত চেতনার সুর। মাঠে-ময়দানে, যুদ্ধক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধার কণ্ঠে তখন উচ্চারিত হয়েছে এসব কবিতা।

আমাদের কবি-সাহিত্যিকরাও প্রতিরোধে শামিল হয়েছেন যার যার অবস্থান থেকে। যে-দুঃসহ দিন অতিবাহিত করেছে বাংলার মুক্তিকামী মানুষ; মুক্তিযুদ্ধকালের সেসব রূপ ফুটে উঠেছে আমাদের কবিতায়। বলাবাহুল্য যে, চল্লিশের কবিদের হাতে এই অঞ্চলের আধুনিক ধারার কবিতা রচনার সূচনা হয়েছিল। পঞ্চাশে এসে আমাদের কবিতা রাজনৈতিক অভিঘাতে পরিপূর্ণ রূপ নিয়ে দাঁড়ায়। তখন থেকে পূর্ববাংলার কবিতা আলাদাভাবে চিহ্নিত হয়ে যায়। আমাদের অস্তিত্বের সংগ্রাম, প্রতিবাদী উচ্চারণ-আমাদের আলাদা রূপে চিহ্নিত হতে সাহায্য করেছে। পঞ্চাশের কবিরা এর সফল রূপকার। এই মহত্তম শিল্পের ব্যাপক প্রসারও সাধিত হয় এদের হাতে। নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের অসাম্য, বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ভাষার প্রতি সচেতন অবজ্ঞা, পরবর্তীকালের সামরিক শাসন সংবেদী মানুষ হিসেবে কবিদের চেতনার জগতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলে। পঞ্চাশের কবিরা সমবেত কণ্ঠে এর বিপক্ষে অবস্থান নেয় এবং উচ্চারণ করে অগ্নিসম জ্বালাময়ী কাব্যচরণ-‘কাজ কি চোখের প্রসন্নতায়/ লুকিয়ে রেখে প্রেতের অট্টহাসি।/ আমার কাঁধেই নিলাম তুলে/ আমার যত বোঝা/ তুমি আমার বাতাস থেকে/ মোছো তোমার ধুলো/ তুমি বাঙলা ছাড়ো।’ শোষকের মুখে থুথু ছিটিয়ে বাংলা ছাড়ার যে-আহ্বান কবিতার শব্দে উচ্চারিত হয়েছে, তা বাংলা কবিতার শক্তিকে নতুনভাবে উন্মোচন করেছে। বাংলার মাটি, নিসর্গ, অসমতার প্রতি ক্ষোভ, ঘৃণা প্রকাশের মোক্ষম অস্ত্র এসব কবিতা। তা চূড়ান্তভাবে বিকশিত হয়েছে পঞ্চাশের কবিদের হাতে, মানুষের কাছে গ্রহণীয় হয়েছে, সমাজে সম্মানিত হয়েছেন কবিরা।

ষাটের দশকের কবিদের উত্থান বাঙালির প্রবল ঝঞ্ঝামুখর সময়ে, ইতিহাসের রাজনীতি তোলপাড়-করা এক পরিসরে। তখন ছিল বাঙালির সাংস্কৃতিক অধিকার আদায়ের জন্য প্রাণান্ত সংগ্রামের কাল। বাঙালি জাতীয়তাবাদের ও স্বাধিকার আদায়ের প্রশ্নে কবি-চৈতন্য জাতীয় পরিবেশের অনুগামী হয়ে উঠেছিল। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক শিল্পজ্ঞান ও কবিতার রূপান্তরের ভেতর দিয়ে সে সময়ের কবিতা বিশ্বকবিতার সমগামী হয়ে উঠেছিল। ষাটের দশকের কবিদের মধ্যে অনেকে এখনও সক্রিয় রয়েছেন, আমাদের কবিতায় অবদান রেখে চলেছেন। স্বাধীনতা-পূর্ব পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের কবিতার ভুবন ছিল কবিতার সৃষ্টিপ্রাচুর্যে প্রাগ্রসর বাংলা কবিতার গৌরবের কালপরিসর।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর কবিতার ভুবনে আসে প্রবল জোয়ার। একটি রাষ্ট্রের জন্মক্ষণ প্রত্যক্ষ করা যে কোনো মানুষের জন্য অনন্যসাধারণ ঘটনা। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ যেমন নতুন পতাকা পেয়েছে, তেমনি পেয়েছে তরতাজা অনুভূতির বাক্সময় প্রকাশ-আমাদের কবিতার ভুবন। এরকম পরিবেশে সৃষ্টিপ্রাচুর্যে কবিতার প্লাবন বয়ে যাওয়া স্বাভাবিক। সে সময়ের কবিতা যেন গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তগোলাপ। প্রায় পাঁচ শতাধিক কবির আবির্ভাব আমাদের কবিতার অঙ্গনকে মুখর করে তুলেছিল।

যে-রক্তস্রোতের মধ্য দিয়ে সাঁতার কেটে আমরা কূলে উঠেছিলাম, সেই রক্তের দাগ তো কবিতার শব্দে লেগে থাকবে-এটাই স্বাভাবিক। কবিতার চরণে উঠে এসেছে আর্তকণ্ঠের চিৎকার, কামানের গোলার শব্দ, গেরিলার যুদ্ধকৌশলের বর্ণন। এই সময়ের শিল্পশুদ্ধ কবিতাগুলো বাংলা কবিতার অনিবার্য উল্লেখযোগ্য সংযোজন। পঞ্চাশ-ষাটের পাশাপাশি সত্তরের কবিরাও বাংলাদেশের কবিতার প্রধান কারিগররূপে গণ্য হয়েছেন। সত্তরের কবিদের মধ্যে এখনও অনেকে দারুণভাবে সৃষ্টিশীল। সত্তরের কবিতা শিল্পসম্মত বিশুদ্ধ উচ্চারণের জন্য টিকে থাকবে আবহমান বাংলা কবিতার অঙ্গনে। এরা শিল্পের শুদ্ধতায় বিশ্বাসী, দার্শনিক-প্রজ্ঞায় স্থিত। এছাড়াও যুদ্ধোত্তর প্রথমপাদের সব কবিতা সাহিত্যের ইতিহাসের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ।

পূর্ববর্তী দশকের উত্তরাধিকার নিয়ে আসে আশির দশকের কবিকুল। দশক বিভাজন কোনো কবির জন্য বড় ব্যাপার নয়। মহাকালের বিচারে যারা টিকে থাকবেন তারাই গুরুত্বপূর্ণ কবি। দশক বিভাজনের বিষয়টি আলোচনার সুবিধার্থে আলোচকরাই বিবেচনায় নেন। এমনটি হওয়াও অস্বাভাবিক নয় যে, অন্যকালের কোনো কবি ডুবসাঁতারে অন্য কূলে গিয়ে নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে চান। তাতে কবিতার কোনো মঙ্গল বয়ে আনে না। স্রোতের দাগ মাথায় থেকেই যায়। কবিতাটাই সবসময় বিবেচ্য বিষয় হয়ে থাকে। আশির দশকেরও গুরুত্ববহ কয়েকজন কবি আমাদের কাব্যাঙ্গনে অবদান রেখে চলেছেন। তারাও সমস্বরে কবিতায় যাপিত সময়কে তুলে এনেছেন কালের বিস্তৃত ক্যানভাসে, স্মৃতিভাষ্যে ও স্ব স্ব প্রজ্ঞার আলোকে।

নব্বইয়ের কাল বাংলাদেশের রাজনীতিতে পতন-উত্থানের দোলাচলের এক সময়। এ সময়ে আবির্ভূত কবিদের হাতে ইতিহাসের পর্যবেক্ষণ ও নিজস্ব বোধের ভাবনার প্রকাশ পরিলক্ষিত হয়েছে। তারা স্বকালকে আত্মগত উপলব্ধিতে কালের প্রতিমা করে তোলার প্রয়াসী। নিরীক্ষাপ্রবণতা অনেকের মধ্যে লক্ষযোগ্য হয়েছে। তাদের উচ্চারণে লোকজ আবহ, অতিবাস্তবতা, চিত্রকল্প ইত্যাদির ব্যবহার নতুনভাবে কবিতাকে উপস্থাপনের প্রয়াস রয়েছে। এর পরে শূন্যদশক, অর্থাৎ একবিংশ শতকের সূচনাকাল। এই সময়ের তরুণকণ্ঠের আবির্ভাবে নতুন স্বর কানে বাজে। তারা আত্মানুসন্ধানের প্রতীকরূপে কবিতাকে দাঁড় করানোর চেষ্টায় রত। কবিতায় নতুনত্বের প্রয়াসী।

প্রত্যেক কালে এই প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়, এবং একসময় কবিরা স্বরূপে স্থিত হন। শূন্যদশক যেমন, তেমনি প্রথম দশকের তরুণদের মধ্যেও নতুনভাবে বলার প্রবণতা লক্ষ করা গেছে। সাম্প্রতিক দ্বিতীয় দশকেও নতুনদের কারো কারো কবিতায় বিদ্যুতের স্ফুলিঙ্গ পাঠককে আশান্বিত করে। এরা কবিতায় শব্দের নতুন ব্যঞ্জনা সৃষ্টির প্রত্যাশী।

আমরা দেখতে চাই, আগামীতে নতুন কবিদের হাতে রচিত হবে বাংলাদেশের কবিতার সমৃদ্ধ সোপান। কবিরা মুক্তির দিশারী, মানবতার পূজারি। কবিরা হবেন সবসময় অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে, অসত্যের বিরুদ্ধে এবং মানবতার পক্ষে সোচ্চার কণ্ঠ-চিরসুন্দরের ধ্বজাধারী।

 


আপনার মতামত লিখুন :
More News Of This Category

ফেসবুকে আমরা